স্কুল-কলেজের পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু বিষয় আবশ্যিক হিসেবে শেখানো এবং চর্চা করানো হয় । বাংলা, ইংরেজি, অংক, ইতিহাস, বিজ্ঞান এ সবের অন্তর্গত তা প্রায় সবাই জানেন । এই সবের বাইরেও অনেক বিষয় আছে যা যে কোনো মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা বা সফলতার ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ । এই বিষয়গুলো অবশ্য কোনো কোনো স্কুল-কলেজে কিংবা পরিবারের পক্ষ থেকেও শেখানো হয়ে থাকে।
পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হলেও পরবর্তীতে আলোচিত বিষয়গুলোর প্রথম পাঁচটি আবশ্যিক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত । এই যোগ্যতাগুলো না থাকলে জীবন অচল হয়ে যেতে পারে এবং পদে পদে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে । অন্যান্য যোগ্যতাগুলো কেউ অর্জন করতে পারলে জীবনে প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে, সকলের কাছে যোগ্য মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে।
পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত কিছু গুরুত্বপুর্ণ যোগ্যতা
০১) প্রয়োজনীয় সকল ক্ষেত্রে শারিরীক সক্ষমতা এবং সাহসিকতা অর্জন (দৈনন্দিন কাজকর্মে আত্মনির্ভরশীল হওয়া): বয়স অনুযায়ী হাঁটা-চলা, দৌড়ানো, পানিতে সাঁতরানো, ভারী জিনিস উত্তোলন, বহন, যানবাহনে উঠা-নামা, গাছে ওঠা ইত্যাদি বিষয়ে সকল মানুষের যোগ্যতা অর্জন করার বিষয় বোঝানো হচ্ছে । সাধারণত পরিবারের লোকেরাই এসব শিখিয়ে থাকে। একটি শিশুর জন্মের পর থেকে পনের বছরের মধ্যে এই যোগ্যতাগুলো অর্জন করে ফেলা উচিত । পরিবারের কর্তা ব্যাক্তিদের উচিত শিশু/তরুণদের এই যোগ্যতাগুলো মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখা।

০২) সাধারণ স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান এবং ফার্স্ট এইড বিষয়ক ধারনা: কী ভাবে রোগ-ব্যাধি হয়, ছড়ায়, কী ভাবে সুস্থ থাকা যায়, কী ভাবে মানুষের সেবা করতে হয়, সাধারণ কাটা- ছেঁড়ার চিকিৎসা জানা এবং করতে পারা ইত্যাদিকে বুঝানো হচ্ছে । হাই স্কুলের স্বাস্থ্য বিষয়ক বই থেকে এগুলো জানা যেতে পারে । পরিবারে, আত্মীয়স্বজনদের ভেতরে ডাক্তার/ নার্স থাকলে তাদের কাছ থেকে এ সব শিখে নেয়া যেতে পারে । স্কুল কলেজে কর্মশালার মাধ্যমে তরুণ এবং যুবকদের এ সব শেখানো যেতে পারে । টিভি চ্যানেলগুলো এ সব বিষয়ে রুটিনমাফিক অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে।
০৩) ঘরে-বাইরে সাধারণ কিছু কাজ করতে জানা এবং অভ্যস্ত হওয়া: অনেক ছেলেমেয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবার চামচ দিয়ে প্লেটে নামিয়ে নিতে পারে না; এটা খুব দুঃখজনক । এ রকম বিছানা গোছানো, কাপড় ভাঁজ করা, কাপড় ইস্ত্রি করা, ঘর পরিষ্কার করা, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি সবারই শেখা উচিত । পরিবারের কর্তাদের উচিত তরুণদের দিয়ে এ সব কাজ শেখানো এবং মাঝে মাঝেই করিয়ে নেয়া।
০৪) সাধারণ কিছু সহযোগী যন্ত্রপাতির ব্যবহার জানা: প্রত্যেক বাড়িতে কিংবা অফিসে সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি থাকে; যেমন- স্ক্রু-ড্রাইভার, প্লাইয়ার্স, ইলেক্ট্রিক টেস্টার, ছুরি, কাঁচি, মোবাইল ফোনের চার্জার ইত্যাদি। খুব ছোট-খাটো কিছু হলেও প্রত্যেক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিশেষ বিশেষ টেকনিক আছে। এ সব যন্ত্রপাতিতে অভ্যস্থ না হয়ে হঠাৎ ব্যবহার করতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে।
০৫) রাস্তায় চলাচলের নিয়মকানুন জানা এবং রাস্তায় চলাচলে অভ্যস্থ হওয়া: একটি শিশুকে একদিন কারো সাহায্য ছাড়াই রাস্তায় হাঁটতে হবে, রাস্তা পারাপার করতে হবে ব্যস্ত শহরে । এ ব্যাপারে সঠিক ভাবে অভ্যস্থ না হওয়া কতটা বিপজ্জনক, তা প্রায় সবাই জানেন । কোনো শিশু বা তরুণ এ বিষয়ে পুরোপুরি অভ্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে রাস্তায় ছাড়াই উচিত নয় । এই বিষয়ে বই এবং ভিডিও প্রকাশ হওয়া উচিত। এ বিষয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠান প্রচার হতে পারে । দেশের স্কুলগুলো এ বিষয়ে শিক্ষামূলক ভিডিও দেখাতে পারে এবং প্র্যাকটিস করাতে পারে।
০৬) কম্পিউটার এবং এর প্রয়োজনীয় কিছু সফট-অয়ারের ব্যবহার জানা: বর্তমানকালে স্কুল-কলেজে কম্পিউটারের ব্যবহার শেখা বাধ্যতামূলক হয়ে থাকতে পারে । স্কুল-কলেজে শেখানোর ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়, ইনটেনসিভ কেয়ার নেয়ার সুযোগ থাকে না । প্র্যাকটিসের সুযোগও সকল জায়গায় থাকে না । ছাত্রের নিজের কিংবা তার পরিবারে কম্পিউটার থাকলে এবং ব্যবহারের সুযোগ থাকলে তাদের কম্পিউটার বিষয়ক জ্ঞান ও পারদর্শিতার বিকাশ ঘটতে পারে । কম্পিউটার বিষয়ক জ্ঞান ও পারদর্শিতার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:
১. কম্পিউটারের হার্ডঅয়ার এবং সফটঅয়ার সম্পর্কিত জ্ঞান,
২. এমএস ওয়ার্ডের সাহায্যে লেখা, ফরমেট করা, প্রিন্ট করা, সেভ করা,
৩. কম্পিউটারে ফোল্ডার, ফাইল ইত্যাদির অবস্থান জানা, এগুলো বিষয় অনুসারে সাজাতে পারা,
৪. কম্পিউটারে ফোল্ডার/ফাইল এক জায়গা থেকে কপি করে কিংবা তুলে নিয়ে অন্য কোথাও বসানো,
৫. কম্পিউটারের মাধ্যমে মেইল আদান-প্রদান,
৬. গুগলে সার্চ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের প্রবন্ধ খুলে পড়তে পারা,
৭. ক্যামেরায় কিংবা মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা ছবি কপি করে কম্পিউটার হার্ড ডিস্কে নিয়ে মৌলিক সম্পাদনা করতে পারা ইত্যাদি ।
০৭) বিভিন্ন ধরনের মাপ-জোখ বোঝা ও করতে পারা: মাপ- জোখের একক জানা, দৈর্ঘ্য, ক্ষেত্রফল, ওজন ইত্যাদি বাস্তবে মাপতে পারা ।
০৮) সুন্দর করে কথা বলতে পারা: কথা বলার ব্যাপারটি শিশুরা প্রথমত শিখে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে । পরিবারের সদস্যগণ শুদ্ধ ভাষায় কথা বললে শিশুরাও তা অনুকরণ করে থাকে । তরুণ বা যুবক বয়সেও শুদ্ধ উচ্চারণের চর্চা করা উচিত । উচ্চারণভঙ্গি এমন হওয়া উচিত যাতে প্রতিটি শব্দ এমন কি অক্ষর স্পষ্টভাবে বোঝা যায় । কারো উচ্চারণে আঞ্চলিকতার টান থাকলে আস্তে আস্তে তা পরিহার করা উচিত ।
কথা বলায় শুধু শুদ্ধ উচ্চারণ নয়, কথা বলার মধ্যে মাধুর্য তৈরি হওয়া চাই । শব্দ উচ্চারণের সাথে মুখভঙ্গি ও শরীরের অঙ্গভঙ্গিও সুন্দর হওয়া চাই । অন্যদিকে কথা বলার বিষয়বস্তুও গ্রহণযোগ্য ও শালীন হওয়া প্রয়োজন ।
কথা বলার সময় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যাকে কিছু বলা হচ্ছে তাকে পরিমাপ করতে পারা । কম বয়স্ক, বেশি বয়স্ক, বন্ধু, শিক্ষক, আত্মীয়-অনাত্মীয়, পূর্ব পরিচিত, অপরিচিত সবার সাথে একই ভাবে কথা বলতে নেই ৷ বয়স হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি মানুষের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া চাই । অনেকেই আছে যার সাথে কথা বলছে তার রি-অ্যাকশন বুঝতে পারে না অথবা বুঝতে চায় না । বিপরীত দিকের মানুষটি কি বিরক্ত হচ্ছে, রেগে যাচ্ছে না কি সুখ পাচ্ছে বিষয়টি সারাক্ষণ বিবেচনায় থাকা উচিত ।
০৯) সুন্দর করে বর্ণনা করতে পারা: কথা বলা আর বর্ণনা করা কিছুটা ভিন্ন জিনিস । বর্ণনা করা মানে কোনো ঘটনা কিংবা কোনো দৃশ্য বর্ণনা করা ইত্যাদি । কোনো পারদর্শী বর্ণনাকারী এমনভাবে বর্ণনা করে যেন শ্রোতার সামনে তা বাস্তবে উপস্থিত হয় । এটা করতে পারা একটা মূল্যবান গুণ । ভালো কোনো গল্পকারের গল্পের বই পড়ে বর্ণনা করার যোগ্যতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব । ভালো শিক্ষকগণের বর্ণনাপদ্ধতিও অনুকরণযোগ্য ।
১০) হাঁটা-চলার স্টাইল সুন্দর করা: হাঁটা-চলার মাধ্যমে একজন মানুষের শারিরীক সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান, ভদ্রতা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে । হাঁটা-চলা এবং চোখের চাহনী থেকে বোঝা যাওয়া উচিত মানুষটির একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে, ফালতু কেউ নয় । হাঁটা-চলার স্টাইল পরিবর্তন করতে গিয়ে যেন বাড়াবাড়ি কিছু না হয়ে যায় । বিষয়টি নিজে নিজে না করে কোনো অভিজ্ঞ ইন্সট্রাক্টরের অধীনে হওয়া উচিত ।
১১) দৃষ্টিকটু অভ্যাস/আচরণ বর্জন: শিশুকিশোর এমন কি বড়দের কিছু দৃষ্টিকটু আচরণ থাকতে পারে, যা সারা জীবন চলতে পারে । বড়দের উচিত শিশুকিশোরদের এ সব আচরণ বর্জনে উৎসাহিত করা। বড়দের এ রকম দোষ থাকলে নিজের চেষ্টায় তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত । তবে কেউ তাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করলে ভালো হয় । আচরণগুলো যেমন হতে পারে: (ক) কারো কথা শোনার সময় হা করে থাকা, (খ) রেগে রেগে কথা বলা, (গ) তোতলানো, (ঘ) শরীর/মুখম-ল না ঘুরিয়ে তেরছাভাবে তাকানো, (ঙ) ঘন ঘন থুথু ফেলা, (চ) খামাখা গলা খাকারী দেয়া, (ছ) কুঁজো হয়ে বসা, (জ) লোকজনের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত স্থান চুলকানো ইত্যাদি ।
১২) আচরণে কেতা দুরস্ত হওয়া: আচরণের গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল:
১. মানুষকে গুরুত্ব দেয়া । হাসিমুখে কথা বলা । কথায় কথায় বিরক্তি প্রকাশ না করা,
২. সম্পর্ক এবং অবস্থান অনুযায়ী সম্বোধন করা । বয়ষ্ক লোক (তিনি বাসার কাজের লোক হলেও) সম্মান দেখিয়ে সম্বোধন করা এবং কথা বলা,
৩. যখন-তখন সমালোচনা করতে না যাওয়া,
৪. শব্দচয়নে সাবধান হওয়া, ইত্যাদি ।
শিশু কিংবা তরুণরা কেতা দুরস্ত হয় সাধারণত বড়দের দেখে দেখে । তারপরও বড়দের উচিত শিশু-কিশোরদের ভালো আচরণ প্র্যাকটিস করানো। মজার ব্যাপার হল, ছোটদের সাথে ভালো আচরণ করলে (যেমনটি আমরা বড়দের সাথে করে থাকি) তারাও সম্মান নিয়ে বড়দের সাথে আচরণ করবে ।
১৩) খেলাধুলা ও ব্যায়ামে পারদর্শী হওয়া: শিশু, তরুণ এবং যুবকদের শারীরিক ও মানষিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা এবং ব্যায়াম খুবই প্রয়োজন । স্কুল এবং বাড়িতে খেলাধুলার চর্চা শুরু হয় । উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে সেই চর্চা অল্প দিনেই বন্ধ হয়ে যায় । খেলাধুলা বিষয়ে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, ছেলেমেয়েরা এখন টেলিভিশনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খেলা দেখতে বেশি ব্যস্ত, নিজেরা খেলবে কখন, তারপর আবার মাঠ নাই । খেলাধুলা না করার কারণে আমরা একটি দুর্বল প্রজন্ম পাচ্ছি। তিনটি কারণে আমাদের সন্তানদের খেলাধুলা করানো উচিত, ১) সুস্থ শারীরিক বিকাশ, ২) ভালো খেলোয়াড় তৈরি করা এবং ৩) সুস্থ বিনোদন । দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টির চেয়ে প্রথমটিকে গুরুত্বের সাথে ভাবা উচিত। সে জন্য খেলাধুলার সুযোগ সকল শিশু, তরুণ এবং যুবকের জন্য খোলা থাকা প্রয়োজন। অন্য দিকে যাদের মধ্যে বিশেষ সম্ভাবনা আছে তাদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে স্থানীয় বা জাতীয় খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে।
১৪) ছবি/নকশা আঁকতে পারা: ছবি আঁকাকে প্রায় সবাই সৌখিন কাজ হিসেবে দেখে থাকে । অথচ ছবি আঁকার বিষয়টি ভবিষ্যতে একটা দরকারী বিষয়ে পরিণত হতে পারে । কোনো লিখিত বর্ণনাকে পরিপূর্ণতা দিতে ছবি কিংবা নকশার প্রয়োজন হয় । ছবি আঁকায় দক্ষতা অর্জন করলে তা সোনায় সোহাগা হতে পারে । যথাযথভাবে চর্চা হলে সেই মানুষটি ভবিষ্যতে একজন ভালো পেইন্টার কিংবা গ্রাফিক ডিজাইনারে পরিণত হতে পারে ।
ছবি আঁকাকে যদি সৌখিন কাজ হিসেবেই দেখা হয়, সেটাও কম কিছু নয়। এটা করে আনন্দের মধ্যে সময় কাটানো যায়, অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায়, মূল্যায়ন হয়।
যে কোনো শিশু বা তরুণের শিল্পী সত্ত্বার বিকাশ ঘটাতে হলে তত্ত্বাবধান প্রয়োজন । তা স্কুলে হতে পারে কিংবা বাড়িতে শিক্ষক নিয়োগ করেও করা যেতে পারে।
১৫) ক্যামেরা/মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলতে পারা: একজন তরুণ যদি মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়েও ছবি তোলার প্র্যাকটিস শুরু করে, তবে তার দেখার চোখ খুলে যেতে পারে । ক্যামেরায় তোলা ছবি দিয়ে সে নানান বিষয় বর্ণনা করা শিখবে । বিভিন্নভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে সে একদিন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারে পরিণত হতে পারে।
সৌখিনতা হিসেবে ফটোগ্রাফি আরো বেশি আনন্দের । বাংলাদেশের অনেক সৌখিন ফটোগ্রাফার আছে, যারা ছবি তুলতে সারা দেশ চষে বেড়ায় । আমাদের দেশটা কত সুন্দর তাদের তোলা ছবি দেখলে তা বোঝা যায় । ছবি দেখাও আনন্দের, নিজের তোলা ছবি দেখতে আনন্দ আরো বেশি । প্রত্যেক মানুষ দেশে, সমাজে, বন্ধুমহলে বিশেষায়িত হতে চায় । ফটোগ্রাফি চর্চার মাধ্যমে একজন মানুষ আলাদা পরিচয় তৈরি করতে পারে।
১৬) কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে পারা: উপস্থাপনা করতে হলে কিছু মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থেকে হাসিমুখে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা যথেষ্ট যোগ্যতার কাজ । পরিবারে কিংবা স্কুলে শুধুমাত্র উপস্থাপনা শেখার স্বার্থে অনুষ্ঠান করা যেতে পারে । উপস্থাপনা শেখানোর জন্য বিখ্যাত উপস্থাপকদের উপস্থাপন করা অনুষ্ঠান দেখানো যেতে পারে, শিক্ষার্থীদের তাদের নকল করে উপস্থাপনা প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে । শিক্ষাথীদের উপস্থাপনা রেকর্ড করে তাকেই আবার দেখানো যেতে পারে, যাতে সে নিজেই নিজের দুর্বলতাগুলো দেখতে পায়।
১৭) অভিনয়/আবৃত্তি/গান ইত্যাদিতে পারদর্শী হওয়া: শিশু এবং তরুণেরা টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন ও নাটকে প্রচুর অভিনয় দেখে থাকে । অভিনয় দেখে তারাও অভিনয়ে উদ্বুদ্ধ হতে পারে এবং অনুকরণ করে শিখতে পারে । তাদেরকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে ভিডিও করে নাটিকা তৈরি করে তাদেরকে দেখানো যেতে পারে । এটা করা বর্তমান সময়ে খুবই সহজ । দেশের প্রতিটি শহরেই বিয়ের ভিডিও করার লোক আছে । ভিডিও এডিট করার প্রতিষ্ঠানও আছে প্রচুর । ছেলেমেয়েরা নিজে থেকেই গান গাওয়ার প্র্যাকটিস করে থাকে । অভিভাবকগণ একটু উৎসাহ দিলে এবং ভালো শিক্ষকের সহযোগিতা পেলে তারা অনেক দূর এগোতে পারে।
১৮) অনেক মানুষের সামনে কথা বলা বা কোনো পারফরম্যান্স দেখাতে পারা: ঘরে একা একা কিংবা শিক্ষকের সামনে অভিনয়, কবিতা পাঠ কিংবা গান গাইতে পারলেও অনেক মানুষের সামনে দাঁড়ালে তার কণ্ঠ শুকিয়ে আসতে পারে । বেশি মানুষের সামনে নিয়ে দাঁড় করানোর আগে ছোট পরিসরে অনেকবার প্র্যাকটিস করানো দরকার । অনেকবার প্র্যাকটিস করলে কাজগুলো সহজ হয়ে আসবে এবং সাহস বাড়তে থাকবে।
১৯) গল্প-কবিতা কিংবা কোনো বিষয়ে মৌলিক লেখা লিখতে পারা: লেখালেখির চর্চাটা স্কুলেই শুরু হয়ে থাকে । সমস্যা হলো ছাত্ররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বই পড়ে মুখস্থ করে সেটাই লিখে থাকে । এতে করে শিক্ষার্থীর প্রতিভার বিকাশ ঘটে না,
মৌলিকত্ব আসে না । শিক্ষার্থীরা যাতে নিজের ভাবনা থেকে লিখতে পারে, সে ব্যাপারে শিক্ষক এবং অভিভাবকগণের কর্মসূচি নেয়া উচিত।
যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীরা গরু বিষয়ে একটি রচনা লিখবে । বইয়ে ছাপানো গরু বিষয়ে রচনাটি পড়তে না দিয়ে গরুর ওপর একটা ভিডিও দেখানো যেতে পারে । শিক্ষার্থীরা ভিডিওটা একাধিকবার দেখবে, মনে রাখবে, এরপর নিজের মন থেকে রচনাটা লিখবে।
২০) অপেক্ষাকৃত সুন্দর জিনিস/কিছু বাছাই করতে পারা: মানুষের জীবনে শত শত রকম জিনিস বাছাই করে চলতে হয় । যেমন, পোশাক বাছাই করা, রঙ বাছাই করা, পেশা বাছাই করা, খাদ্য বাছাই করা, মানুষ বাছাই করা, ইত্যাদি অনেক কিছুই বাছাই করতে হয় । বাছাই করার যোগ্যতার বিকাশ ঘটতে সময় লাগতে পারে। নানাভাবে শিশু- কিশোরদের বাছাই করার প্র্যাকটিস করানো যেতে পারে । যেমন, কম্পিউটার মনিটরে একাধিক রকমের পোশাক দেখিয়ে কোনটা ভালো, তাদেরকে দিয়ে পছন্দ করানো যেতে পারে । ভালো ফটোগ্রাফারদের ছবি দেখিয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবিটি বাছাই করতে দেয়া যেতে পারে । একটি নাটক কিংবা সিনেমা দেখিয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করা যেতে পারে, এখানে কোন চরিত্রটি, কোন ঘটনাটি তোমার ভালো লাগে এবং কেন ভালো লাগে । বিষয়গুলো শিশুকিশোররা বেশ উভভোগ করবে, তাদের পছন্দ এবং রুচির বিকাশ ঘটবে।
২১) অন্যের অবস্থা বোঝার সক্ষমতা অর্জন এবং সে অনুযায়ী সাড়া দেয়া: অন্যের মনের অবস্থা বোঝার সক্ষমতা অর্জন করতে বয়স এবং অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে । তবে অনেকে কম বয়সেই অন্যের মনের অবস্থা বুঝতে পারে আর অনেকে বেশি বয়সেও পারে না।
কথা বলতে শেখে নাই, এমন বাচ্চারাও চেহারা দেখে অন্যের মনের অবস্থা বুঝতে পারে । যেমন, তার সামনে হাসলে সেও হাসে, তার সামনে কাঁদলে সে বিমর্ষ হয় । এ ভাবে সাড়া দেয়াটাই স্বাভাবিক । তবে বড় হলে অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যাত্যয় ঘটে । বড় হয়ে অনেকে অন্যের দুঃখ বোঝে না, সাড়াও দেয় না । এটা ঘটার সম্ভাব্য কারণ হল, মানুষ যতই বড় হয়, নিজের স্বার্থের জ্ঞানটা ততই বাড়ে । শুধু তাই নয় বড় হওয়ার পর মানুষের মনোযোগ নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে আবর্তিত হয় । এর কারণে সে সব রকম বিষয়ে মনযোগ দিতে চায় না । এটা ঠিক স্বার্থপরতা নয়, এটা বাস্তবের প্রয়োজন । যেমন একজন ছাত্র পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, আত্মীয় স্বজনের বিপদ নিয়ে সে সাড়া নাও দিতে পারে । সে জানে, বিষয়টি নিয়ে কিছু করার জন্য বড়রা আছেন । তবে বিষয়গুলো তাকে একদম ভাবায় না তা কিন্তু নয়।
একজন মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার চিন্তার পরিসর বাড়তে থাকে । শিশু বয়সে সে বাবা-মা, ভাই- বোনদের বিষয়েই ভাবে । যখন সে স্কুলে পড়ে তখন সে বন্ধুদের নিয়েও ভাবে । যখন সে কলেজে পড়ে তখন সে দেশ নিয়েও ভাবতে পারে । প্রত্যেকটি মানুষকে একজন সংবেদনশীল মানুষে পরিণত হওয়া প্রয়োজন।
তরুণদেরকে পরীক্ষা করা যেতে পারে, তারা অন্য মানুষদের নিয়ে ভাবে কি না । মানুষদের নিয়ে ওরা কিছু করতে চায় কি না, তাও জানা উচিত । বাস্তবসম্মত উপায়ে তারা যদি কিছু করতে চায় তবে পরামর্শ ও অর্থসাহায্য দিয়ে তা করতে দেয়া উচিত।
২২) সাধারণ কিছু রান্না করতে পারা: রান্না-বান্না করার জন্য নির্দিষ্ট লোক থাকলেও প্রত্যেক মানুষের তরুণ বয়স থেকেই অতি প্রয়োজনীয় কিছু খাবারের রান্না জানা উচিত । যেমন- ভাত, ডাল, ডিম ভাজা, সহজ পদ্ধতির খিচুরি, রুটি তৈরি, ফ্রিজের খাবার বের করে গরম করা, ইত্যাদি । খাওয়ার পর থালা-বাসন ধুয়ে জায়গামত রাখার অভ্যাসও গড়ে ওঠা উচিত ।
কেন রান্না করা শিখতে হবে? রান্না করার দায়িত্বে যিনি থাকেন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন । তখন কি সবাই না খেয়ে থাকবে? এ ছাড়া যিনি রান্না করতেন তাকেও তো খাওয়াতে হবে । ছেলে বা মেয়ে যেই হোক ষোল বছরের মধ্যেই রান্নার এই কাজগুলো শিখে ফেলা উচিত।
২৩) সাধারণ কিছু যানবাহন চালাতে পারা: সাধারণ যানবাহন বলতে বাইসাইকেলকে বুঝানো হচ্ছে । কোনো কোনো পরিবারে মোটর সাইকেল এমনকি মোটর গাড়ি থাকতে পারে । ছেলে কিংবা মেয়ে সাধারণ বাইসাইকেল চালানো শেখা কঠিন কোনো কাজ নয়।
২৪) কোনো অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করতে পারা: তরুণদেরকে জন্মদিন, বনভোজন কিংবা পারিবারিক যে কোনো প্রোগ্রামের পরিকল্পনা তৈরি করতে দেয়া যেতে পারে । এটা করলে তাদের কল্পনা শক্তি এবং দায়িত্ববোধ দুটোই বাড়বে । তাদের তৈরি করা পরিকল্পনাকে তাদের সামনেই প্রয়োজন মতো পুনর্বিন্যাস করে মূল পরিকল্পনা বানানো যেতে পারে।
২৫) ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠা: কোনো কাজ শুরু করার আগে তা কেন করা হবে, তার যুক্তি অনুসন্ধান এবং এর ফলাফল বা পরিণতি, লাভ এবং ক্ষতির দিকগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা । তাড়াহুরো, হঠকারিতা এবং সাময়িক আবেগ পরিহার করা । বিভিন্ন সময়ে শিশুকিশোরদের স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পরে স্বাধীনভাবে নেয়া তাদের সিদ্ধান্ত এবং কর্মকা- বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে হবে । একটি গল্পের অংশবিশেষ বলে প্রশ্ন করা যেতে পারে, “বলো, তুমি হলে এখানে কী করতে?”
২৬) অন্যদের সহ্য করা এবং মিলেমিশে চলার অভ্যাস গড়ে ওঠা: শিশুকিশোরদেরকে তাদের ভাইবোন, প্রতিবেশী এবং সহপাঠীদের সাথে সহনশীল হয়ে বন্ধুত্বপুর্ণ আচরণে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে হবে । তাদের সাথে মেলামেশার সুযোগ দিয়ে আড়াল থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, প্রয়োজনে তাদের মাঝে গিয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিশুকিশোরদেরকে তাদের বন্ধুদের জন্য দোয়া/আশির্বাদ করতে বলা যেতে পারে । তাদের বন্ধুদের বাসায় এনে বড়দের সাথে পরিচয় করানো যেতে পারে । এভাবে তারা সামাজিক হয়ে গড়ে উঠবে।
২৭) সতর্কতা এবং আত্মরক্ষার যোগ্যতা অর্জন: একটা শিশু কোথাও হারিয়ে গেলে সে কি তার পিতামাতার নাম এবং ঠিকানা বলতে পারবে? এখনই পরীক্ষা করে দেখুন । সে কি বুঝতে পারে, কে তার ক্ষতি করতে পারে এবং কী ভাবে তাদেরকে এড়িয়ে যাবে কিংবা আত্মরক্ষা করবে, বাড়িতে কোনো বিপদজনক ঘটনা ঘটলে সে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে।
২৮) বৃত্তিমূলক কোনো একটি কাজ শেখা: স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে কে কোন পেশায় অবতীর্ণ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই । স্কুলের একজন ছাত্র সঠিকভাবে বলতে পারবে না, কর্মজীবনে সে কী করবে । ছাত্রজীবন শেষ করে অনেকের ভালো কোনো চাকুরি হয় না । অনেকেই বেকারত্বের অভিশাপ ঘাড়ে নিয়ে জীবন যাপন করতে থাকে । ভবিষ্যৎ জীবনে কে কী হবে, তা যাই হোক, স্কুল বা কলেজ জীবনে ছেলেমেয়েরা দুয়েকটি বৃত্তিমূলক কাজ শিখে রাখতে পারে । যেমন:
১. কম্পিউটারে বাংলা/ইংরেজি ভাষায় কম্পোজ করে প্রিন্ট করা,
২. গ্রাফিক ডিজাইন করা,
৩. কাঠ/বাঁশ/বেতের জিনিসপত্র তৈরি করা,
৪. সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করা, কাপড় কেটে সেলাই করে সাধারণ কিছু পোশাক (যেমন- পাজামা, পাঞ্জাবী, সেলোয়ার, কামিজ) তৈরি করা,
৫. ছবি বাঁধাই করা,
৬. পাসপোর্ট ছবি তুলে, ফটোশপে রিসাইজ করে প্রিন্টারে প্রিন্ট করা, ছবি থেকে ছবি তৈরি করা,
৭. বাসাবাড়ির ইলেকট্রিক লাইন ঠিক করা (অবশ্যই একজন এক্সপার্টের তত্ত্বাবধানে শিখতে হবে),
৮. কম্পিউটার হার্ডঅয়ার সংযোজন, সফটঅয়ার ইনস্টলেশন এবং প্রয়োজনীয় সারাই কাজ,
৯. গাড়ি ড্রাইভ করা, ইত্যাদি ।
বৃত্তিমূলক কোনো কাজ শেখার উপকারিতা হল, জীবনের যে কোনো সময়ে বেকার হয়ে পড়লে শেখা ঐ কাজটি নতুন পথ দেখাতে পারে ।
২৯) সুবিবেচনা অর্জন: বিবেচনা হল, অন্যের ও নিজের মঙ্গল-অমঙ্গল, সুবিধা, স্বার্থ, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া । মনে করুন একজন মা পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, তার সন্তান মায়ের কাছে গিয়ে জোরে শব্দ করল না; এটা হল সুবিবেচনা । বয়স হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটা মানুষের সুবিবেচনা অর্জন করা উচিত । বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে শিশু-কিশোরদের বিবেচনাবোধ পরীক্ষা করা যেতে পারে, বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করে তাদেরকে শেখানো যেতে পারে ।
৩০) কল্পনা শক্তির বিকাশ: কল্পনা করা মানে হলো, যা সামনে নেই, তাকে মনের পর্দায় দেখা । সব ধরনের সৃষ্টিশীল কাজে কল্পনায় বিষয়টি দেখা খুবই জরুরী । যিনি ছবি আঁকেন, তিনি আঁকার আগে তার মনের পর্দায় ঐ ছবিটির একটি প্রতিরূপ এঁকে ফেলেন । যিনি উপন্যাস লেখেন, তিনি মনের পর্দায় ঐ ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে দেখতে থাকেন । যিনি ভালো পরিকল্পনা করেন, তিনি তার কল্পনায় ভবিষ্যত দেখতে থাকেন । সাধারণ সকল কাজেও কল্পনার ব্যবহার হয় । অনেক
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে মানুষের কল্পনা শক্তির ভূমিকা ছিল । আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি বিখ্যাত উক্তি হল :
“The power of imagination is more important than knowledge”
অর্থাৎ
“কল্পনাশক্তি জ্ঞানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ণ”।
শিশু-কিশোর এবং যুবকদের কল্পনা শক্তির বিকাশ হবে কী ভাবে?
ক) একটি গল্পের প্রথম কিছু অংশ বলে দিয়ে গল্পের বাকী অংশ বলতে বা লিখতে দেয়া,
খ) মনের পর্দায় একটি নকশা আঁকতে বলা এবং পরে সেটি কাগজে আঁকতে বলা ।
গ) উপন্যাস পড়লে এবং শুধুমাত্র শব্দের মাধ্যমে যে নাটক হয় (যেমন- রেডিওতে যেসব নাটক শোনানো হয়) তা শুনলে মনের পর্দায় দৃশ্যের কল্পনা চলতে থাকে, এতে করে মানুষের কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি পায় ।
ঘ) শিশু-কিশোরদের কল্পনার কোনো একটা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে, এর পর কী অবস্থা হতে পারে, তা বলতে বা দেখাতে বলা। যেমন: মনে কর, আমরা সমুদ্রের নিচে পানির ভেতর হাঁটছি, মাছের মত নিশ্বাস নিতে পারি এবং তারপর অথবা মনে কর, আমাদের প্রজাপতির মতো পাখা আছে, তা হলে আমরা কী কী করতে থাকব?
ঙ) নিয়মিত মেডিটেশন কল্পনাশক্তিকে প্রখর করতে পারে ।
এ রকম আরো অনেক উপায় থাকতে পারে শিশুকিশোরদের কল্পনা শক্তি বাড়ানোর জন্য ।
প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের কল্পনা নেগেটিভ এবং পজিটিভ এই দুই রকম হতে পারে । নেগেটিভ কল্পনা মানুষকে সতর্ক করতে পারে, আবার কাজে নিরুৎসাহিত করতে পারে । নেগেটিভ কল্পনা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত । পজিটিভ কল্পনা মানুষকে জীবনের কর্মকান্ডে আগ্রহী করে তোলে ।
‘সাইকেল চালাতে গেলে সেটি কাৎ হয়ে পড়ে যাবে’ এটি একটি নেগেটিভ কল্পনা । ‘সাইকেলটি গতিশীল থাকলে সেটি কাৎ হবে না’ এটি একটি পজিটিভ কল্পনা । ‘সাইকেল থেমে যাওয়ার আগে পা নামিয়ে সেটাকে দাঁড় করাতে হবে’ এটা হল সাবধানতা ।
৩১) পরে কী/কী কী ঘটতে পারে তা কল্পনা করতে পারা: সোজা কথায় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া। যদি একটি শিশুকে প্রশ্ন করা হয়, একটি কলার ছাল রাস্তার মাঝখানে ফেলে রাখলে কী কী ঘটতে পারে । শিশুর কাছে থেকে দুটো ভাবনা আশা করা যেতে পারে: (ক) রাস্তায় চলা মানুষ মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটবেন, নিচে তাকাবেন না, কলার ছালে পা দিয়ে তিনি পিছলে পড়বেন । (খ) অন্য একজন মানুষ রাস্তায় তাকিয়ে হাটার সময় কলার ছালটি দেখতে পাবেন, অন্য কারো বিপদ হতে পারে, এই ভেবে সেটি তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলবেন । এভাবে ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া কোনো শিশুর মানুষ হয়ে ওঠার জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ ।
৩২) জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ পেশা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হওয়া: মানুষ তার মেধা, আগ্রহ, বিশ্বাস, সুযোগ এ সবের ওপর ভিত্তি করে তার জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং পেশা নির্ধারণ করে । প্রত্যেক মানুষকে সচ্ছল হতে হবে । হাই স্কুলে পড়ার সময়েই একজন তরুণের কাছে তুলে ধরা উচিত কী কী পেশা তার জন্য অপেক্ষা করছে, সাথে সাথে তার আগ্রহের বিষয়টাও যাচাই করা উচিত । আগ্রহের সাথে পেশা মিলে গেলে তা ভালো, তবে সবার জীবনে এমন সুযোগ নাও আসতে পারে।
জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য বলে একটা বিষয় আছে । যেমন, আপনার জীবনের সময় ও যোগ্যতা কী উদ্দেশ্যে নিবেদিত? তা কি নিজে সুখে-স্বাচ্ছন্দে থাকা, দেশ-জনতার সেবা, না কি অন্য কিছু । জীবনের কোনো একটি সময়ে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে । পৃথিবীর সফল মানুষদেরকে শিশুকিশোরদের সামনে তুলে ধরতে হবে । তারা যেন বুঝতে পারে যে মানুষ কেবল তার নিজের জন্য নয়, মানুষ মানুষের জন্য ।
শিশুকিশোরদের বড় কিছু স্বপ্ন দেখাতে হবে, তবে তা অবশ্যই সম্ভাবনাকে বিচার করে । স্বপ্ন এবং বাস্তব যেন বেশি দূরত্বের না হয় ।
৩৩) চিন্তাভাবনার ওপর নিজের আধিপত্য অর্জন: মানুষের মন একটা খোলা প্রান্তরের মতো । যখন তখন যে কোনো বিষয়ের ভাবনা এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে। যে কোনো কাজ সফলভাবে করতে হলে ঐ কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। ঐ সময় অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ভাবনা মনের ভেতর ঢুকে পড়লে কাজটি আর ভালো ভাবে করা হয় না । চিন্তাভাবনার ওপর নিজের আধিপত্য অর্জন মানে অপ্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনাকে তাড়িয়ে দিয়ে মূল ভাবনায় ফিরে আসতে পারা। জীবনে সফল হতে হলে এই গুণটি অর্জন করা খুবই জরুরী ।
মেডিটেশন এবং ধর্মীয় প্রোগ্রাম নিজের চিন্তার জগতের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করতে পারে ।
৩৪) আত্মশাসনে অভ্যস্থ হওয়া: ২৯ (সুবিবেচনা) এবং ৩৩ (ভাবনার ওপর আধিপত্য) এই দুটি গুণ অর্জন করতে পারলে নিজেকে নিজে শাসন করার যোগ্যতাও আপনা আপনি অর্জিত হবে। যা কিছু অন্যায়, অশালীন এবং ক্ষতিকর তা থেকে সে নিজে থেকেই সরে দাঁড়াবে। প্রত্যেক তরুণ কিংবা যুবক দিনরাত্রির মধ্যে পাঁচ মিনিট সময় মেডিটেশনের মত করে আত্মসমালোচনার প্র্যাকটিস করতে পারে।
৩৫) জীবনের বিভিন্ন রকম কর্মকাণ্ডে এবং চিন্তাভাবনায় ভারসাম্যপুর্ণ হওয়া: ভারসাম্য অর্জন করার জন্য প্রথম শর্ত হল তুলনামূলক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারা । এই গুরুত্ব অনুযায়ী সময় ভাগ করতে হয় । মনে করি একজন ছাত্রের ১৪ ঘণ্টা কর্মসময়ের মধ্যে ১০ ঘণ্টা পড়ালেখা, ২ ঘণ্টা খেলাধুলা, ১ ঘণ্টা টিভি দেখা এবং ১ ঘণ্টা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার কথা । সে যদি ২ ঘণ্টা লেখাপড়া আর ১০ ঘণ্টা খেলাধুলা করে, সেটা হবে ভারসাম্যহীনতা । শিক্ষক কিংবা অভিভাবকদের উচিত শিশুকিশোরদের দিনরাত্রির রুটিন তৈরি করে দেয়া এবং সে অনুযায়ী চলায় উৎসাহিত করা ।
৩৬) প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আনুগত্যের অভ্যাস গড়ে ওঠা: জীবনের অনেক ক্ষেত্রে আনুগত্য একটি বাধ্যতামূলক বিষয় । (ক) সন্তানরা একটা বয়স পর্যন্ত পিতামাতার আনুগত্য করবে, (খ) ছাত্ররা সাধারণ শিক্ষা বা কোনো প্রশিক্ষণ চলাকালীন শিক্ষকের আনুগত্য করবে, (গ) কোনো কর্মকান্ড চলাকালীন নেতার আনুগত্য করবে, (ঘ) কর্মজীবনে উপরস্থ কর্মকর্তা/কর্মচারীর আনুগত্য করবে, ইত্যাদি । আনুগত্যের চর্চা শিশু বয়স থেকেই নিজ পরিবার পরিম-লে শুরু হতে হবে । আনুগত্যের অভ্যাস প্রথম জীবনে তৈরি না হলে পরবর্তী জীবনে সে একগুয়ে (ঘাউরা) মানুষে পরিণত হতে পারে, যা তার নিজের এবং তার পরিচালকদের জন্য সমস্যা তৈরি করবে । শিশুদের নির্ধারিত নিয়মে খেলাধুলা এবং কাজ করানোর মাধ্যমে আনুগত্য এবং নিয়মানুবর্তিতা শেখানো যেতে পারে ।
৩৭) আনন্দে থাকা এবং আনন্দে রাখা: পরিস্থিতি বা প্রাপ্তি যাই হোক হাহুতাস কোনো ভালো ফলাফল দেয় না । জীবনের যে কোনো খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজেকে আনন্দিত রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণ বয়স থেকেই সারাক্ষণ খুশী থাকার অনুশীলন জরুরী । চোখেমুখে খুশির আভা মানুষের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে ।
নিজে আনন্দিত থাকা যেমন একটা বিষয়, নিকটজন কিংবা সামনের মানুষদের আনন্দিত রাখার প্রচেষ্টাও জরুরী একটা বিষয় । পিতামাতা যেমন সন্তানদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করে, সন্তানদেরও উচিত পিতা-মাতাকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করা । কথায় এবং কাজে বন্ধুদের, অধীনস্থদের এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আনন্দিত রাখার চেষ্টা একটি মহৎ গুণ । এই গুণটি সকলের মধ্যে বিকশিত হওয়া প্রয়োজন । মানুষকে আনন্দিত রাখার প্রধান মাধ্যমগুলো হল: (ক) হাসিমুখে কথা বলা, (খ) শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়া, (গ) সুযোগ (access) দেয়া, অর্থাৎ মানুষ যেন তাকে কিছু বলতে ভয় না পায়, (ঘ) সম্ভবমত রসিকতা করা, (ঙ) সম্ভবমত সাহায্য করা কিংবা পরামর্শ দেয়া, ইত্যাদি । এভাবে মানুষকে আনন্দে রাখার ফলাফল এমন দাঁড়াতে পারে যে, তার অনুপস্থিতি এক সময় মানুষকে কষ্ট দেবে ।
৩৮) কোনো একটা হবি (শখের কাজ) তৈরি হওয়া: হবি বা শখের কাজ মানুষকে আনন্দে থাকতে এবং অবসর কাটাতে সাহায্য করে । প্রচলিত হবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাগান করা, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি, ছবি দেখা, ভ্রমণ, ঘুরি ওড়ানো, সাইকেল চালানো, সেলাই, ছোট-খাটো কিছু তৈরি করা ইত্যাদি । শিশুকিশোরদের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, হবি যেন তাদের মূল কাজ (যেমন, লেখা-পড়া) থেকে প্রাধান্য পেয়ে না বসে । ছোটবেলার হবি বয়সকালে খুব ভাল কাজ দেয় । বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে যখন সে সব জায়গা থেকে অবসর নেয়, তখন হবির মধ্যে ডুবে থেকে নিজের একটা জগত তৈরি করে নিতে পারে ।
জীবন যেন একটা কারাগারে পরিণত না হয় । সততা এবং নিয়মানুবর্তিতার ভেতরে সেটা যেন উপভোগ্য হয়।
৩৯) ধৈর্য এবং সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন: প্রত্যেক মানুষকে জীবনের শুরুতেই বুঝতে হবে, জীবন ফুলের বিছানা নয়, এখানে কষ্ট আছে, কষ্ট এবং চেষ্টার পর প্রাপ্তিও আছে । যে কোনো প্রাপ্তি এবং সফলতার জন্য সময়ও লাগে । মানুষ ঠিক যেমনটা চায়, প্রাপ্তিটা ঠিক তেমনটা হয় না । কোনো বিষয়ে অনেক চেষ্টা সাধনার পরও ব্যর্থতা চলে আসতে পারে । চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে ছাড় দেয়া বা মেনে নেয়ার কিছু বিষয় থাকে । জীবনকে থামিয়ে দেয়া যাবে না, অনেক সময় নতুন উদ্যম এবং আশা নিয়ে পথ পরিবর্তন করতে হবে ।
একজন তরুণ যা চায়, তার সব কিছু দেয়া তার পরিবার থেকে সম্ভব নয়, অথবা সঙ্গত নয় । শিশুকিশোররা নিজ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এ সব জানবে । তবে বড়দেরও উচিত কিছু বিষয় ব্যাখ্যা করে দেয়া ।
প্রয়োজনে মানুষকে দুপুরের রোদে হাঁটতে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়, বড়দের ধমক শুনেও মেনে নিতে হয়, ধৈর্যের সাথে অপছন্দনীয় অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় । বাধাবিপত্তির মধ্যেও মানুষকে সিদ্ধান্তে, কর্মকা-ে অটল থাকতে হয় । শিশুকিশোরদের কষ্ট করতে দিন, তাকে সহ্য করায় উৎসাহিত করুন । কষ্টের মধ্য দিয়েও মানুষ মূল লক্ষে এগিয়ে যায়, এ রকম ঘটনা নিয়ে অনেক সিনেমা, নাটক কিংবা ডকুমেন্টারি আছে, শিশুকিশোরদের সেগুলো দেখানো যেতে পারে । অনেক পথ হেঁটে অতিক্রম করা, পাহাড়ে ওঠা, ধৈর্যের সাথে কাজ করার জন্য পুরস্কৃত করা ইত্যাদি সত্যিকার প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে শিশুকিশোরদের ধৈর্য বাড়ানো সম্ভব । মুসলমানদের জন্য রোজা ধৈর্য এবং সহ্য করার ক্ষমতা অর্জনে সহায়ক হতে পারে ।
৪০) পরিবার থেকে দূরে থাকার অভ্যাস গড়ে ওঠা: একটি শিশু বা তরুণকে সবসময় বা সারাজীবন তার পিতা-মাতার সাথে বসবাস করা সম্ভব হবে না । শিক্ষার প্রয়োজনে তাকে বাড়ি থেকে দূরে ছাত্রাবাসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থাকার প্রয়োজন হতে পারে । সেই পরিবেশে খাপ খাওয়ার জন্য আগে থেকেই তরুণদেরকে তৈরি করতে হবে । কর্মজীবনে মানুষকে নিজ দেশে বাড়ি থেকে অনেক দূরে এমনকি বিদেশেও অবস্থান করতে হয় । ভিন্ন ধরনের জীবনযাত্রায়, আবহাওয়ায়, খাদ্যাভ্যাসে অভিযোজন করতে না পারলে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে ।
৪১) আধ্যাত্মিকতা অর্জন: মানুষের সৃষ্টিরহস্য, জন্মমৃত্যু, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক, মৃত্যু পরবর্তী জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে একটি শিশু, তরুণ কিংবা যুবকের ধারণা কেমন হতে পারে, তা নির্ভর করবে তার চলমান ধর্মবিশ্বাসের ওপর । তবে এই বিষয়গুলি কোনো তরুণ কিংবা যুবকের কাছে প্রশ্ন হিসেবে না থেকে সুরাহা হয়ে যাওয়া উচিত ।
৪২) জীবনের ঘটনাবলী, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে পজিটিভলি (ভালো চোখে) গ্রহণ করার যোগ্যতা: ভালো চোখে দেখার প্রবণতা মানুষকে শান্তি দেয় এবং কর্মোদ্দীপনা বজায় রাখে । যেমন, ‘কারো বাবা একজন সামান্য শ্রমজীবি মানুষ’ । বিষয়টাকে ভালো চোখে দেখলে, ‘আমি শ্রমজীবি পরিবারে জন্মেও পরিশ্রম করে অনেক বড় কিছু হব, বাবাকে সহজেই সন্তুষ্ট করতে পারব’।
৪৩) মানুষের বিশ্বাস অর্জন: একজন তরুণ কিংবা যুবককে তার পরিচিত সবাই যেন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে জানে । সবার ধারণা তৈরি হবে, সে কারো ক্ষতি করবে না বরং সুযোগ পেলে উপকার করবে । ভালো মানুষ হিসেবে ইমেজ/ সুনাম তৈরি হওয়া নিজের ভবিষ্যতের জন্য জরুরী। জীবনের একাধিক কর্মকা-ের মাধ্যমে এটি তৈরি হয় । মনে রাখতে হবে, যোগ্যতার চেয়ে বিশ্বস্ততার মূল্য বেশি । সুনামের চেয়ে দুর্নাম একশ গুণ বেশি গতিতে ছড়ায় । মানুষের আস্থা/বিশ্বাস একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা সাধারণত ফিরে আসে না ।
তরুণদের মধ্যে চারিত্রিক সমস্যা থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের ব্যবস্থা করা উচিত । তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে । তাকে সত্য বলায় অভ্যস্ত করে তোলা উচিত । যে সকল পরিবারে কিংবা স্কুলে তরুণদের বাড়াবাড়ি রকমের শাস্তি দেয়া হয়, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শাস্তি থেকে বাঁচতে তারা মিথ্যের আশ্রয় নিতে থাকে, এক সময় মিথ্যে বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । দুনিয়ার প্রায় সকল অন্যায়ের মূল হল মিথ্যে বলা ।
৪৪) সিদ্ধান্তে অটল থাকার যোগ্যতা অর্জন: কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পর যাদের সিদ্ধান্ত কচুর পাতার পানির মত টলমল করে, তারা কখনও সফল হতে পারে না । অনেক সিদ্ধান্ত অল্প সময়ের জন্য নেয়া হয়, কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পুরো জীবনের জন্য । ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন মানুষের সময়, অর্থ এবং ঐকান্তিকতা নষ্ট করে । তাদের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়, ফালতু মানুষে পরিণত হয় । কোনো তরুণ কিংবা যুবক যা কিছু সঙ্গত সিদ্ধান্ত নেবে, বড়দের উচিত তা বাস্তবায়নে সহায়তা করা এবং সমাপ্তি/সফলতা আসা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা ।
৪৫) টাইম ম্যানেজমেন্ট/সময়ের পরিকল্পিত ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া: মানুষের পুরো জীবন একটি সময় । ছাত্র জীবন, কর্ম জীবন এবং শেষ বয়সে অবসর জীবন; পুরো জীবনকে এভাবে ভাগ করা যায় । দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর এভাবেও সময়কে ভাগ করা যায ।
ব্যক্তি জীবনে টাইম ম্যানেজমেন্টের কথা ভাবতে হলে প্রথম বিবেচনায় আসবে জীবনে বৃহত্তর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে কি না । যে মানুষ সফল হতে চায় তাকে সময় ভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে; একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় অর্জন করতে হবে । নির্দিষ্ট সময়ে সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হল, সময়ের অপচয় রোধ করে মূল কাজে বেশি/পরিমিত সময় দেয়া । সময়ের অপচয় রোধ করার জন্য ক) ভোরের নির্দিষ্ট সময়ে শয্যা ত্যাগ করে নির্দিষ্ট সময়ে দিনের কর্মঘণ্টা শুরু করতে হবে । ঘুমাতে যাওয়ার সময় নির্ধারিত থাকতে হবে । খ) খামাখা সময় নষ্ট করে, এমন কাজ বা অভ্যাস বাদ দিতে হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশনে/ইউটিউবে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখা, ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকা, বন্ধুদের সাথে অপ্রয়োজনীয় আড্ডাবাজি এগুলো এতটাই সময় নষ্ট করে যে, প্রয়োজনীয় কাজ করার সময় থাকবে না । সখের কাজে বেশি সময় দিলেও এমনটা হতে পারে । কোনো কারণে মন খারাপ হলে, কারো সাথে বিবাদে লিপ্ত হলেও প্রচুর সময় এবং শক্তির অপচয় হয়। গ) যে সকল আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব সময় নষ্ট করতে বাধ্য করে, তাদেরকে কৌশলে পরিত্যাগ করতে হবে। ঘ) অসুখ- বিসুখেও প্রচুর সময় নষ্ট হতে পারে, সে জন্য সুস্থ থাকার সকল পন্থা অবলম্বন করতে হবে ।
সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার পেতে গুরুত্ব বুঝে কাজগুলোকে ভাগ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সময়ের পরিকল্পনা করতে হবে। দিন এবং রাতের কাজের জন্য নির্ধারিত সময়টুকুতে কী কী করা হবে তার একটি তালিকা থাকতে পারে । পরের দিনের পরিকল্পনা আগের রাতেই করা যেতে পারে । এ ব্যাপারে অবিভাবকগণ শিশু এবং তরুণদেরকে সহায়তা করতে পারেন ।
প্রত্যেক শিশু/কিশোর/যুবকের জন্য কিছু বার্ষিক পরিকল্পনাও থাকতে পারে । যেমন, এই বছর নির্দিষ্ট মাসে একজন কিশোর সাইকেলে চড়া এবং সাতার শিখবে, ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার পর সে কোনো ইন্সটিটিউটে ফটোগ্রাফি শিখবে, ইত্যাদি ।
একজন তরুণ/যুবককে মনে রাখতে হবে, তার জীবনের একটা মিশন আছে । যাদের জীবনে কোনো মিশন নাই, তাদের সাথে নিজেকে মিলানো যাবে না ।
আপনার সন্তান, ছাত্র কিংবা অধিনস্থদের কোন কোন যোগ্যতার বিকাশ ঘটাবেন, তা নির্বাচন করতে অভিজ্ঞ কোনো শিক্ষকের পরামর্শ নিতে পারেন । তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ, জন্মসূত্রে পাওয়া (genetic) গুণাবলী, সময়ের প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ও বিবেচ্য ।
আপনি কি আপনার সন্তান, ছাত্র কিংবা অধিনস্থদের অথর্ব হিসেবে দেখতে চান? নিশ্চয়ই নয় । তাদেরেকে সর্বোচ্চ সফলতায় দেখতে হলে তাদের যোগ্যতার সার্বিক বিকাশ প্রয়োজন । সার্বিক বিকাশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে । পরিকল্পনা এবং প্রচেষ্টায় না গিয়ে সময়ের হাতে ছেড়ে দিলে তারা হয়ত শারিরীকভাবে মানুষ হবে, কিন্তু নিজের, পরিবারের, সমাজের, দেশের কিংবা মানবতার জন্য ভালো কিছু করার মত সফল মানুষ তারা হবে না, বরং এরা নিজেরাই পরিবার এবং সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাড়াতে পারে । পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হবে, কিন্তু এটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় । জীবনের সফলতা আর বোর্ডের পরীক্ষার সফলতা এক বিষয় নয় । যারা বোর্ডের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে থাকে তাদের সবাই কিন্তু সফল মানুষ হয় না।
আপনি হতে পারেন মানুষ তৈরির শিল্পী
এই আলোচনায় পাঠ্যতালিকা বহির্ভূত যে যোগ্যতাগুলো উল্লেখ করা হল, এ রকম আরো অনেক কিছু থাকতে পারে । একজন মানুষ সবগুলো অর্জন করতে পারবে, এমন নয় । সব মানুষের মেধা, পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত গুণাবলী, আগ্রহ এবং সুযোগ সুবিধা এক রকম নয় । বিশেষ কোনো বিষয়ে মেধা থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে অনেকের জীবনে তা বিকশিত হয় না । মানুষ তৈরি হওয়ার পেছনে একজন জ্ঞানী, দায়িত্ববান এবং শুভাকাঙ্ক্ষী পরিচালক/নির্দেশক/উপদেষ্টা দরকার আছে । তিনি হলেন মানুষ তৈরি করার শিল্পী। তিনি হতে পারেন পিতা-মাতা, শিক্ষক, ভাই কিংবা বন্ধু । যদি কারো তা থাকে, তবে সে ভাগ্যবান। এমন কেউ না থাকলে নিজেই নিজের নির্দেশক হতে হবে ।
রফিকুল ইসলাম