ক্রিয়েটিভ শব্দটির বাংলা অর্থ হল সৃজনশীল । ক্রিয়েটিভিটি মানে হল সাধারণ বা প্রচলিত থেকে ভিন্ন (অসাধারণ) কিছু সৃষ্টির বিষয় যার সঠিক (পারফেক্ট) বা সুনির্দিষ্ট ফলাফল কিংবা কারো (শিল্পীর) কল্পনার ক্যানভাসে আঁকা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপুর্ণ ফলাফল পেতে সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
ক্রিয়েটিভিটি’র কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বা সীমারেখা নাই। সময়ের পরিবর্তনে নতুন বিষয় এক সময় পুরাতন কিংবা প্রচলিত বিষয়ে পরিণত হয় । ফটোগ্রাফি যখন কেবল চালু হয় তখন যে কোনো বিষয়ের ফটোগ্রাফি-ই সৃজনশীল ঘটনা ছিল। কালের আবর্তনে যে কোনো বিষয়ের যে কোনো ভাবে ছবি তোলা এখন আর ক্রিয়েটিভিটি হিসেবে ধরা যায় না ।
পারফেকশনের জন্য যা কিছু করা হয়, তা ক্রিয়েটিভ বলে মনে না-ও হতে পারে। অনেকেই ভাবেন, শুধুমাত্র স্পেশাল ইফেক্ট’র কাজগুলোই ক্রিয়েটিভ। আমি মনে করি পারফেকশনের জন্য নিজের কারিগরী জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরিক্ষা ব্যবহার করে যা কিছু করা হয়, তা-ও ক্রিয়েটিভিটি’র অন্তর্গত ।
ক্যামেরায় ফুল-অটো-মোড (যেখানে শাটার স্পিড, অ্যাপারচার, আইএসও, হোয়াইট ব্যালেন্স সবই ক্যামেরা নিজে সেট করে) সেট করে কেউ যদি একটি সাদা কাগজ বা কাপড়ের ছবি তোলে, তবে সাদা জিনিসটি ছবিতে সাদা না এসে মিড গ্রে ধারন করে । এটা হল সাধারণ প্রক্রিয়া যা সাধারণ মানুষ করে থাকে। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফার এই কাজটি ফুল-অটো-মোডে না করে ম্যানুয়াল এক্সপোজার মোডে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে জেনে-বুঝেই দুই স্টপ ওভার করে ছবিটি তোলেন এবং সাদা জিনিসকে ছবিতে সাদাই পেয়ে থাকেন । পারফেকশনের জন্য কাজটি এভাবে করাও ক্রিয়েটিভ কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়বে।
একজন ভিডিওগ্রাফার রাতের বেলায় কম আলোয় ভিডিও করতে যাচ্ছেন, তিনি চাচ্ছেন একটু আঁধার হোক, যাতে ভিডিওটি রাতের মনে হয়। ভিডিও ক্যামেরাটি যদি অটো-এক্সপোজার মোডে থাকে, তবে অটো-ব্যবস্থা এক্সপোজার বাড়িয়ে রাতের কম উজ্জ্বল জিনিসগুলোকে ভিডিওতে দিনের আলোয় দেখার মতো উজ্জ্বল বানিয়ে দেবে। এখানে ভিডিওটি যদি স্বাভাবিক এক্সপোজার থেকে এক স্টপ আন্ডার করা হয়, তবে এটি ডার্কার হবে এবং রাতের আবহ তৈরি হবে। যদি অটো-হোয়াইট ব্যালেন্স ব্যবহার না করে ডে-লাইট হোয়াইট ব্যালেন্স ব্যবহার করা তবে রাতের আলোর রঙিন আভা ভিডিওতে থাকবে, তা সময়ের বাস্তবতা তৈরি করবে। এই কাজগুলো করা হচ্ছে ভিডিওতে নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য পাওয়ার জন্য, যা ভিডিওগ্রাফার তার কল্পনায় দেখেন এবং আশা করেন। এটাকে অবশ্যই সৃষ্টিশীলতা বলতে হবে।
নতুন কেউ একজন ক্যামেরায় ফুল-অটো-মোড (যেখানে শাটার স্পিড, অ্যাপারচার, আইএসও, হোয়াইট ব্যালেন্স সবই ক্যামেরা নিজে সেট করে) ব্যবহার করে কম আলোতে রাস্তায় গতিশীল গাড়ীর ছবি তুলল । আলো কম থাকায় ক্যামেরার অটো-ব্যাবস্থা শাটার স্পিডকে স্লো রাখল। ফলাফল হিসেবে ছবিতে গাড়ী, গাড়ীর হেডলাইট মশান ব্লার তৈরি করল, একটা আর্টিস্টিক ইফেক্ট তৈরি হল । এই ভদ্রলোক, যিনি ফটোগ্রাফিক টেকনলজি বোঝেন না, তিনি এই রকম ইফেক্ট পাওয়ার আশা করে ছবিটি তোলেন নি, কী-রকম সেটিং করে এ রকম বৈশিষ্ট্যের ছবি হবে, তা তিনি নিজে থেকে সেট করেন নি (তিনি জানেন না)। এটা হতে পারে ‘ঝড়ে বক মরা, কিছু একটা হয়ে যাওয়া ; সৃজনশীলতা নয় ।
আর্ট ফটোগ্রাফি এবং কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফি উভয় ক্ষেত্রেই সৃজনশীলতার ব্যবহার হতে পারে। একজন ফটোগ্রাফার ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ লাগিয়ে সরাসরি ফ্ল্যাশে একটি পোরট্রেট তুলল, মানুষের ছবির পাশ দিয়ে একটা গাঢ় ছায়া তৈরি হল। এটা কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ নয়। এবার তিনি ফ্ল্যাশকে পাশের সাদা দেয়াল থেকে বাউন্স করে ছবি তুললেন, সেটাতে পাশ দিয়ে গাঢ় ছায়া থাকলো না। এ ছবিটা অপেক্ষাকৃত ক্রিয়েটিভ। ফ্ল্যাশ বাউন্স করার সাথে বিপরীত দিক থেকে একটি রিফ্লেক্টর ব্যবহার করে যদি আরো কোনো বৈশিষ্ট্য দেয়া যায়, তবে সেটা আরো ক্রিয়েটিভ।
সৃজনশীল ফটোগ্রাফি হতে হলে সেখানে কয়েকটি বিষয়ের বিবেচনা প্ৰয়োজন ।
১) চুড়ান্ত ফলাফলটি কী হবে, তা ফটোগ্রাফারের কল্পনায় নির্ধারিত থাকতে হবে ।
২) ফটোগ্রাফের পরিকল্পিত বৈশিষ্ট্য পেতে পদ্ধতি নির্ধারিত থাকবে। হতে পারে তা পুরনো/চলমান কোনো বিশেষ পদ্ধতি কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত নতুন কোনো পদ্ধতি। নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হিসেবে বেশী মূল্যায়ন পাওয়ার দাবী রাখবে ।
৩) সৃজনশীল ফটোগ্রাফ সম্পুর্ণরূপে কল্পনাপ্রসূত, অতি অবাস্তব হতে পারে ।
৪) সৃজনশীল হওয়ার জন্য বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক হওয়া খুবই জরুরী। অপরিকল্পিতভাবে যেমনে-তেমনে পাওয়া ছবি সৃজনশীল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না ৷
সৃজনশীল ফটোগ্রাফি হতে হলে ফটোগ্রাফারের ভাবনাগত এবং পদ্ধতিগত কেরামতি থাকা যেমন প্রয়োজন; তেমনি এর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও খুব প্রয়োজন। ধরুন একজন রাধুনী নতুন ধরনের একটি তরকারী রান্না করল, সে তাতে কোনো লবন দিল না, এই তরকারীটা কেউ খেতেও পারলো না । এই ধরনের কাজ সৃজনশীল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না ।
ছবি তোলার সময় কিংবা পরে অনেকভাবেই সৃজনশীল ফটোগ্রাফ তৈরি হতে পারে
১) দেখার মধ্যে সৃজনশীলতা: সাধারণ মানুষ যেভাবে দেখেন, একজন সৃষ্টিশীল ফটোগ্রাফার তার চেয়ে ভিন্নভাবে দেখতে পারেন । এই পার্থক্যগুলো যতভাবে হয়ে থাকে;
(ক) পয়েন্ট অফ ভিউ সিলেকশন: সাধারণ মানুষ চলতে ফিরতে যে সব পয়েন্ট থেকে বিষয়বস্তুকে দেখে থাকেন, ফটোগ্রাফার তা থেকে ভিন্ন কোনো উচ্চতা, ভিন্ন কোনো পাশ এবং ভিন্ন কোনো দূরত্ব থেকে দেখার চিন্তা করেন। এতে করে বিষয়বস্তু এবং বিষয়বস্তুর সাথে অন্যান্য জিনিসপত্রের গঠন, পার্সপেক্টিভ এবং কম্পোজিশনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে ছবিতে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় ।
(খ) লেন্সের অ্যাঙ্গেল অফ ভিউ সিলেকশন: সাধারণ মানুষ তার মানবীয় চোখ দিয়ে নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেল অফ ভিউ’য়ে দেখেন, কিন্তু একজন শিক্ষিত ফটোগ্রাফার জানেন বিভিন্ন রকম লেন্সে (বিশেষত ওয়াইড, নরমাল এবং টেলি) আরো ভিন্ন ভিন্ন রকম অ্যাঙ্গেল অফ ভিউ তৈরি হয়, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল অফ ভিউ-এর লেন্সকে তিনি ছবিতে নতুন মাত্রা দিতে ব্যবহার করে থাকেন।
(গ) মোমেন্ট সিলেকশন: সাধারণ মানুষ কোনো ঘটনাকে একটা সময় জুরে দেখেন, এক সেকেন্ডের একশ ভাগের একভাগে কী ঘটল তা দেখার সুযোগ পান না। কিন্তু ফটোগ্রাফার তার যান্ত্রিক কৌশলের সুবাদে এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের একভাগে কী ঘটল তা-ও (বিশেষত, ছবি তোলার পরে) দেখতে/দেখাতে পারেন। এ ছাড়া ফটোগ্রাফারের চোখ সাধারণত হরিণের মতো সচকিত, কী ঘটছে, এমনকি কী ঘটতে যাচ্ছে, দৃশ্যপটে কী পরিবর্তন ঘটবে তা-ও তার চেতনায় উঁকি দেয়। শাটার চাপার মোমেন্ট সিলেকশন সৃজনশীল ফটোগ্রাফির অন্যতম একটি দিক ।
২) ছবির বিষয় নির্বাচনের মধ্যে সৃজনশীলতা: সাধারণ মানুষের চোখ অনেক কিছুই এড়িয়ে যায়, দেখলেও গুরুত্ব দেয় না, অর্থাৎ অতি সাধারণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। একজন সৃজনশীল ফটোগ্রাফার সেখানেও সৌন্দর্য, রহস্য কিংবা চিন্তার খোরাক খুঁজে পেতে পারেন এবং ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন ।
৩) কম্পোজিশনের মাধ্যমে সৃজনশীলতা: ছবির ফ্রেমে বিষয়বস্তুর সাথে এর ব্যাকগ্রাউন্ড-ফোরগ্রাউন্ড এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বিষয়কে সাজানো এবং সমন্বয় করার কাজটি হল কম্পোজিশন। বিষয়বস্তু যতই সাধারণ হোক না কেন, ভালো কম্পোজিশনের মাধ্যমে ছবির গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণে বাড়তে পারে, সাধারণ ছবি থেকে অসাধারণ ছবিতে রূপান্তর হতে পারে ।
৪) ক্যামেরায় পরিবর্তনীয় বিষয়সমূহ (অ্যাপারচার, শাটার স্পিড, হোয়াইট ব্যালেন্স ইত্যাদি) প্রয়োজনীয় এবং যৌক্তিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃজনশীলতা:
(ক) অ্যাপারচার: অ্যাপারচার দিয়ে যেমন ছবির ব্রাইটনেস কম-বেশি করা যায়, অ্যাপারচার দিয়ে আবার ডেপথ অফ ফিল্ডও বাড়ানো-কমানো যায়। বিশেষ বিশেষ অ্যাপারচার ব্যবহার করে ফটোগ্রাফার তার পছন্দের মাত্রা অনুযায়ী ডেপথ অফ ফিল্ড তৈরি করতে পারেন। ডেপথ অফ ফিল্ড বেশি মাত্রায় কমিয়ে বিষয়বস্তুর পেছনে থাকা আলোর কণাগুলোকে বোকেহ্-এ রূপান্তর করতে পারেন ।
(খ) শাটার স্পিড: বেশি শাটার স্পিড সেট করে ফটোগ্রাফার গতিশীল বিষয়বস্তুকে ছবিতে ফ্রিজ করে দিতে পারেন । পারফেকশনের নিরীখে এটাও সৃজনশীলতা। আবার স্লো শাটার স্পিড ব্যবহার করে ছবিতে গতিশীল জিনিসগুলোকে মোশান ব্লার করে ভৌতিক রূপ দিতে পারেন ।
স্লো শাটার স্পিডের সাথে ক্যামেরা প্যান করে ছবিতে প্যানিং ইফেক্ট তৈরি করতে পারেন। প্যান করা ছবিতে গতিশীল বিষয়বস্তু শার্প এবং স্থির জিনিসগুলো মশান ব্লার হয়। স্লো শাটার স্পিডের সাথে ক্যামেরার জুম লেন্সকে জুম ইন কিংবা জুম আউট করে ছবিতে জুমিং ইফেক্ট তৈরি করা যায়। এই ইফেক্টে মাঝখানের বিষয়বস্তু মোটামুটি শাপ এবং এর চারদিকের জিনিসগুলো ছিটকে বেড়োনোর মতো হয়ে যায়।
৫) লাইটিং’র মাধ্যমে: বিশেষভাবে লাইটিং করা কিংবা বিশেষ লাইটিং অবস্থা সিলেকশনের মাধ্যমেও সৃজনশীলতা হতে পারে ।
৬) অপটিকাল ফিল্টারের সাহায্যে: ছবি তোলার সময় লেন্সের সামনে বিভিন্ন রকম ফিল্টার ব্যবহার করে ছবিতে বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য তৈরি করা যায়। যেমন, পোলারাইজিং ফিল্টার দিয়ে নীল আকাশকে আরো গাঢ় করা যায় এবং পানির নিচে থাকা বিষয়বস্তুকে আরো পরিচ্ছন্ন দেখানো যায় ।
৭) সফটঅয়ারে এডিট করার মাধ্যমে: ফটোশপ কিংবা এ জাতীয় ফটো এডিটিং সফটঅয়ারের সহায়তায় ছবির সাথে অন্য ছবি/ছবির অংশ বিশেষ জুরিয়ে, রঙ পরিবর্তন করে, ফিল্টার ইফেক্ট দিয়ে, ডজ-বার্ন করে ছবিতে নানা রকম বৈশিষ্ট্য তৈরি করা সম্ভব। তবে এ রকম কাজ করার সময় সর্বশেষ ফলাফলটি কী দাড়াবে তা শিল্পীর কল্পনায় নির্ধারিত থাকতে হবে।
নানাভাবে তৈরি করা সৃজনশীল ফটোগ্রাফের কিছু নমুনা

				
				
				
				
				
				
				
				
				
				
				
				
				
				

								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
								
															
