ফটোগ্রাফি অনেকভাবেই মানব জাতির কাজে আসে। ফটোগ্রাফিকে বাদ রেখে বর্তমান সভ্যতাকে ভাবাই যায় না। আমার এখনকার আলোচনার বিষয় তা নয়। একজন মানুষ, যিনি ফটোগ্রাফি করেন, তার জন্য ফটোগ্রাফি কতটা মঙ্গল আনতে পারে, সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়।

১) ফটোগ্রাফি মানুষকে কর্মব্যস্ত করে তোলে: সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে বেকার সময় কাটানো বড়ই কষ্টদায়ক। এভাবে সময় কাটাতে বিভ্রান্ত হওয়া কিংবা ক্ষতিকর পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনাও তৈরি হয়। এর বিপরীতে ফটোগ্রাফির মতো সৃষ্টিশীল কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠা নিজের এবং সমাজের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক। কেউ যদি সৌখিনভাবে ফটোগ্রাফি করে, সেটা তার কাছে আকর্ষণীয় একটা বিষয় হয়ে যায়, তার মনের টানেই সে বিষয়টি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
২) ফটোগ্রাফি মানুষকে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করায়: ঘরের বাইরে ফটোগ্রাফি করতে প্রচুর হাটাহাটি এবং ওঠাবসার প্রয়োজন হয়। ঘরের ভেতরে বিশেষত স্টুডিওতে ফটোগ্রাফি করার সময়ও প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম হয়। খেলাধুলা করার সময় যেমন শারীরিক পরিশ্রম করতে কোনো মানষিক চাপ পড়ে না, বরং আনন্দের সাথে শরীরের ব্যবহার হয়, ফটোগ্রাফিতেও বিষয়টি একইভাবে ঘটে থাকে। নিয়মিত ফটোগ্রাফি মানে নিয়মিত ব্যয়াম, ফলাফল শারিরীক ও মানষিকভাবে সুস্থ জীবন যাপন।
৩) ফটোগ্রাফি মানষিক চাপ কমায়: দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক মানুষের নানা রকম মানষিক কষ্ট থাকে। না পাওয়ার ব্যাথা থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সব নিয়ে মানুষের মন কাতর হয়ে ওঠে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং কর্মস্থলের চাপও আমাদেরকে মানষিকভাবে পাগলপ্রায় করে তোলে। অনেকদিন যাবৎ মানষিক চাপে থাকলে মানুষ নানাবিধ অসুখে পড়তে পারে। এ ধরনের মানষিক চাপ থেকে মাঝে মাঝে শিথিল হওয়া প্রয়োজন। মানষিক চাপ মানুষের জীবনেথাকবেই। মানষিক চাপ থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পেতে সব চেয়ে ভালো উপায় হল অন্য একটি আকর্ষণীয় এবং আনন্দময় কাজে ব্যাস্ত হয়ে ওঠা। ফটোগ্রাফি সব সময় আনন্দের, হোক তা শখের, হোক তা পেশা। যতক্ষণ এই কাজ করা যায়, ততক্ষণ মানষিক চাপমুক্ত থাকা যায় ।

৪) ফটোগ্রাফি মানুষকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যায়ঃ যারা প্রাকৃতিক দৃশ্য, ওয়াইল্ড লাইফ এবং প্রকৃতির নানা রকম উপাদানের ছবি তোলে, তাদেরকে প্রকৃতির কাছে যেতে হয়, প্রকৃতির সাথে তাদের অন্তরঙ্গতা জন্মে। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা মানে একটা সুন্দর মন। প্রকৃতির কাছে থাকা মানে অক্সিজেনপূর্ণ সুবাতাসে বসবাস ।
৫) ফটোগ্রাফির মাধ্যমে সৌন্দর্যের উপলব্ধি তৈরি হয়: সব শ্রেণীর ফটোগ্রাফার সৌন্দর্য খুঁজে বেড়ায়, সৌন্দর্য সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সৌন্দর্য উপলব্ধি এবং উপভোগ করতে পারা মানুষের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক গুণ। ছবি যে তৈরি করে এবং ছবি যে দেখে দুইজনের মধ্যেই বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। সে মোটা বিষয়াবলী থেকে সূক্ষ্ম বিষয়সমূহের দিকে আকর্ষিত হয়।
৬) ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে মানুষ একটি কারিগরী জ্ঞানের ভাণ্ডার অর্জন করে: জ্ঞান কখনই বোঝা নয়, কেবল বোকারাই জ্ঞানকে বোঝা মনে করে। জ্ঞান মানুষকে ওজনদার করে তোলে। জ্ঞান মানুষের মূল্যায়ন বাড়িয়ে দেয়। জ্ঞান উপভোগ্যও বটে। এই যেমন আমি, সিনেমা দেখার সময় শুধু ঘটনাই দেখিনা, ক্যামেরা মুভমেন্টও উপভোগ করি। আমি যে বুঝি, সেই আত্ম-তৃপ্তি আমাকে আনন্দ দেয়। জ্ঞান উপভোগের গভীরতা এবং ব্যাপ্তী বাড়িয়ে দেয়।
৭) ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে নানাভাবে দেখার চোখ খুলে যায়: ফটোগ্রাফার হওয়ার আগে একজন মানুষ সাধারণ চোখে দেখে। ফটোগ্রাফার হওয়ার পর সে ক্যামেরার চোখে দেখে, লেন্সের বিভিন্ন ফোকাল লেংথে দেখে। সে ছবির দর্শকের জায়গা থেকেও দেখে। ছবি দেখে দর্শক কী কী ভাবতে পারে, তাও সে দেখে থাকে। সে ঘটনার আগে দেখে, পরেও দেখে। সে একটা জিনিসের সাথে অন্যটার অনুসঙ্গ খোঁজে। সে আসল জিনিস দেখে, রূপক জিনিসও দেখে। বাস্তবের মধ্যে তার কল্পনাকেও দেখে। কারণ, ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে সে নিজেকে শিল্পী হিসেবেই ভাবে।
৮) ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে মানুষ নতুন এক ভাষা খুঁজে পায় ভাষা মানে হচ্ছে বর্ণনা করার মাধ্যম। যেমন, আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলে মনের ভাব অন্যের কাছে বর্ণনা করি। বাংলা অক্ষরে বাক্য লিখি। তবে এই ধরনের ভাষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা হল, সবাই সবার ভাষা বোঝে না। তবে বর্ণনা করার কিছু পদ্ধতি সবাই বোঝে। যেমন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইঙ্গিতে-ইশারায় কিছু বোঝানো। বর্ণনা করার সর্বজনবোধ্য একটি মাধ্যম হল ফটোগ্রাফ। ফটোগ্রাফ দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষকে কোনো বিষয় বোঝানো যায়, তা সে যে ভাষারই হোক। একজন মানুষ ফটোগ্রাফি জানে, এর অর্থ হল, সে সর্বজনবোধ্য একটি ভাষা জানে, যা দিয়ে সে পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলের যে কোনো মানুষের মনের দুয়ারে পৌঁছতে পারে। এই ভাষা দিয়ে সে মানুষকে নানাভাবে আনন্দ দিতে পারে, সমমর্মী করে তুলতে পারে, ঘটনা/পরিস্থিতি বর্ণনা করতে পারে, অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারে । এভাবে সমাজ এবং মানবতার উপকারে আসতে পারেন।

৯) বন্ধুত্বের এক বিশাল দুয়ার খুলে যায়: ফটোগ্রাফার যে বয়সেরই হোক না কেন, সব বয়সের ফটোগ্রাফার তার বন্ধু। বিভিন্ন বয়সের সৌখিন ফটোগ্রাফার ছবি তোলার জন্য এক সাথে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে ঘোরাঘুরি এবং ছবি নিয়ে পরস্পরের সাথে আলোচনা-সমালোচনার জন্য অনেক গ্রুপ তৈরি হয়। ফেসবুকের মধ্য দিয়েও ফটোগ্রাফারদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়; নিজ দেশে, এমনকি দেশের সীমানা পেড়িয়ে।
১০) সময় কাটে আনন্দে: জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন সময় নিজেই একটা সমস্যা হয়ে দাড়ায়। ছবি তোলা যেমন আনন্দের, ছবি দেখা তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। নিজের কিংবা অন্য ফটোগ্রাফারের ছবি দেখতে দেখতে আনন্দের স্রোতে ডুবে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। নিজের তোলা কোনো ছবি যখন অন্য কারো প্রসংসা পায়, কোনো প্রকাশনায় স্থান পায় কিংবা কোনো প্রতিযোগিতায় স্থান/স্বীকৃতি পায়, সেটা কতটা আনন্দের তা ঐ ফটোগ্রাফারই ভালোভাবে উপলব্ধি করেন। যিনি ফটোগ্রাফার নন এমন মানুষও নিজের জীবনের বিভিন্ন সময়ের ছবি দেখে অতীতের আনন্দঘন মুহূর্তগুলোর স্বাদ বার বার নিতে পারেন ।
বৃদ্ধ বয়সে যখন একজন মানুষ বয়স এবং স্বাস্থ্যগতগত কারণে আনন্দের অনেকরকম উৎস থেকে অনেক দূরে সরে পড়েন, তখন ছবি তোলা (সম্ভব হলে) এবং ছবি দেখার মধ্য দিয়ে আনন্দপূর্ণ সময়যাপন করতে পারেন।

১১) নিজেকে সার্থক মনে হয়: ‘আমাকে দিয়ে কিছুই হল না, কিছু হবেও না এই জাতীয় ভাবনা মানুষের উৎসাহ এবং শক্তি- সামর্থকে দুমড়িয়ে মুচরিয়ে ফেলে। মানুষের জীবনে ছোটো- খাটো সফলতা-সার্থকতা থাকলে সেটাকে উপলব্ধি করে মানুষ সান্তনা খুঁজে পেতে পারে। সেটা থেকে তার একটা পরিচয় তৈরী হয়। সেটা নিয়ে সে নিজেকে তুলে ধরতেও পারে।
আমার ভাইয়ের মেয়ে তার মেয়েকে বলল, আজ তোর এক নানা আসবে । আমার নাতনী বলল, “কোন নানা?’ ওর মা বলল “তোর যে নানা ছবি তোলে’। নাতনী বলল, ‘নানা ক্যামেরা আনবে?’ আমার প্রতি আমার নাতি-নাতনীদের এইটুকু আগ্রহ, দরদ আমার ভিতরে জীবনবোধ তৈরি করে। মনে হয় ওদের জন্য আমার প্রয়োজন আছে।
১২) ফটোগ্রাফি মানুষকে সামাজিক করে তোলে: ফটোগ্রাফিতে যারা মানুষ নিয়ে কাজ করে, তাদেরকে মানুষের সাথে মিশতে হয়, মানুষের জীবন যাপন, ঘটনা, ভাবনা, চাওয়া-পাওয়া এবং সমস্যা নিয়ে গবেষণা করতে হয়, কাছে গিয়ে দেখতে হয়। এটা করতে গিয়ে তাদের সাথে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে সখ্যতা তৈরী হয়। ফটোগ্রাফি দিয়ে সে মানুষের জীবনকে তুলে ধরে। মানুষের প্রতি তার দায়-দায়িত্বও বেড়ে যায়।
১৩) সহজেই কোনো ডকুমেন্টের কপি করতে পারে: একজন মানুষ তার সাথে থাকা ক্যামেরা দিয়ে কোনো ফ্ল্যাট কিংবা থ্রিডি বিষয় থেকে কপি করতে পারে। ছাত্ররা প্রায়ই ক্লাসে বোর্ডে লেখা/আঁকানো কিংবা সাজানো কোনো বিষয় মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে কপি করে থাকে । ক্যামেরা দিয়ে এমন সব বিষয় কপি করা যায়, যা স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করা সম্ভব নয়।
১৪) বেকারত্ব ঘুচাতে পারেঃ এক সময় মেধাবী যুবকেরা ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নেয়া পছন্দ করত না। একবিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া মেধাবী যুবকেরা আগ্রহের সাথে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে।
যারা শৌখিন ফটোগ্রাফার, তারা চাইলে অল্প কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং কিছু চর্চা করে ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিতে পারে। অনেক শৌখিন ফটোগ্রাফার শৌখিন থাকা অবস্থাতেই মাঝে মধ্যে অর্থের বিনিময়ে কাজ করে থাকে। এতে তাদের ক্যামেরা, লেন্স ইত্যাদি কেনার খরচ উঠে আসে। একজন মধ্যম মানের পেশাদার ফটোগ্রাফার মাসে যে পরিমাণ আয় করে থাকে, তা একজন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে কম নয়।
গত দুই দশকে ফটোগ্রাফারদের সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে। আমার পরিচিত অনেক মানুষ ফটোগ্রাফিকে নির্ভর করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । ইতোমধ্যে কয়েকজন ফটোগ্রাফার রাষ্ট্রীয়ভাবে উচ্চ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
এক সময় ফটোগ্রাফি শুরু করা এবং চর্চা অব্যাহত রাখা বেশ ব্যয়বহুল ছিল। অপেক্ষাকৃত কম দামের কম্প্যাক্ট ডিজিটাল ক্যামেরা এবং মোবাইল ফোনের ক্যামেরার প্রচলন ফটোগ্রাফি চর্চাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। ছবি প্রসেস/প্রিন্ট করার জন্য ল্যাবে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না । একান্ত প্রয়োজনে নিজের কম্পিউটারে সহজেই এডিট করতে পারেন। মোবাইল ফোনে, ট্যাবে কিংবা কম্পিউটার মনিটরে ছবি দেখতে/দেখাতে পারেন। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের সহযোগিতায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা এবং প্রদর্শনীতে অংশ নিতে পারেন।
অতএব ফটোগ্রাফিতে আসুন, শারীরিক ও মানষিকভাবে ভালো থাকুন, নিজের মেধা ও শিল্পবোধকে ফুটিয়ে তুলুন হাজার মানুষের মাঝে
Author: Rafiqul Islam, FBPS