আমার মৃত্যুর পাঁচশ বছর পর অনুমতি পেলাম তিন ঘণ্টার জন্য পৃথিবী দেখে আসার। পরজগত থেকে সোজা এসে চাপলাম আমার নাতির ঘাড়ে। সে আমার দশ পুরুষ পরের নাতি। সেও ছবি তোলে। কীভাবে জানি না তার সাথে কথাবার্তা বলা সম্ভব হচ্ছিল। সে তখন ছবি তুলতে বেরোচ্ছিল। বললাম তোমার ক্যামেরা কই? সে বেল্ট থেকে মোবাইল ফোনের মতো একটা বক্স বের করল। হাতে নিয়ে দেখলাম সেটাতে কোনো লেন্স নাই।
কীরে লেন্স নাই এটাতে ছবি ওঠে ক্যামনে। পাপা, এখন ক্যামেরা মানে হল প্রসেসিং এবং সেভিং ইউনিট। ক্যামেরার আসল কাজটা এখন চোখ দিয়েই করা হয়। চোখ দিয়ে আমরা যখন যে দৃশ্য দেখি বেল্টের সাথে আটকানো এই ক্যামেরায় প্রেস করলেই সেই দৃশ্যটা ইমেজ আকারে এখানে সেভ হয়ে যায়।
সেটা বুঝলাম। কিন্তু ওয়াইড/ নরমাল/ টেলি এসব হবে ক্যামনে?
বলতে না বলতেই পকেট থেকে একটা চশমা বের করল। দেখলাম চশমার কাচে একটা ক্রোপ চিহ্ন আছে।
কোমরে ক্যামেরা রাখা থেকেই ক্রোপ চিহ্নটাকে বড়-ছোট করা যায়। বড় করলে ওয়াইড আর ছোট করলে টেলি হয়ে যায়। বললাম তুই আমার একটা ছবি তুলে দেখা না। ও তখন কী বলল জানেন? ওর সে কথায় একটু দুঃখই পেলাম। ও বলেছিল, দাদা, তুমি কি ভুলে গেছো তুমি এখন মানুষ নও, ভুত। তোমার সেই পেত্নিটাকে সাথে আনো নি কেন?

আমি আমার নাতির ঘাড়ে চেপে রাস্তায় বেরোলাম। আরেকটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম। দুচারটে মানুষকে খুব লম্বা এবং বড় মনে হলো। অন্য মানুষগুলোর তুলনায় তাদেরকে দৈত্যের মতো লাগছিল। নাতি, এরা কোন গ্রহের মানুষ? ও বললো, ওরা সাড়ে পাঁচ ফুট সাইজের মানুষ। আমি বললাম তোরা কি তাহলে তিন ফুট? জী দাদা। বললাম এটা কীভাবে হল? ও যা শোনাল-
দুশ বছর আগে দেশে মানুষ আর ধরানো যাচ্ছিল না। তখন বিজ্ঞানীরা একটা উপায় বের করলো। প্রজনন সক্ষম সকল মানুষকে একটা ওষুধ খাওয়ানো হলো। এর পর যত মানুষ জন্মেছে তাদের কেউ তিন ফিটের বেশি লম্বা হয়নি। শরীরের আকার ছোট হওয়াটাই এখন ভালো চোখে দেখা হয়। আর ঐ যে বড় মানুষগুলো দেখছো ওরা ওষুধ না খেয়ে পালিয়ে ছিল। মানে তোমাদের জাতের মানুষ কিছু রয়েই গেল। ওদেরকে ঢাঙ্গা বলা হয়। আমি একটা হাফ ছাড়লাম, ওওওওও।
ও আরো বললো আমরা যে বাড়িগুলোতে থাকি সেগুলোর রুমের হাইট কিন্তু পাঁচ ফিটের বেশি নয়। আর ঐ বড় সাইজের মানুষগুলোর জন্য আলাদা বাড়ি বানাতে হয়।
আমার নাতি আহসান মঞ্জিলের ছবি তুলছিল। আমি বললাম সোনারগাঁওয়ের পানাম সিটিটা কি এখনও আহেরে। না দাদা ওটা ভেঙ্গে আরেকটা বড় শহর বানানো হয়েছে। সচিবালয়গুলো সব এখন ওখানে।
আমি ওকে বললাম, তুমি যে ছবি তুললে সেগুলো কত মেগাপিক্সেল। ও বলল, এগুলো প্রায় একশো মেগাপিক্সেলের সমান। তবে মেগাপিক্সেল এখন বড় কোনো বিষয় নয় । কেননা ইমেজগুলো এখন আর র্যাশ্টার নয়, ভেক্টর রাশি, যত খুশি বড় করা যায়।
ওর কাছে জানলাম শিল্পকলায় নাকি ফটো-এক্সিবিশন চলছে। আমাকে সেখানে নেয়ার জন্য সাধলাম। সেখানে আরেক দৃশ্য দেখলাম। একটা বিশাল রুমে পঞ্চাশটা বেশ বড় আকারের এলসিডি টাঙ্গানো। পঞ্চাশটা এলসিডিতে পঞ্চাশজন ফটোগ্রাফারের একশটা করে মোট পাঁচ হাজারটা ছবির প্রদর্শনী চলছে। প্রত্যেকটার সামনে একটা রিমোট রাখা আছে, সেই রিমোট চেপে পরপর একশটা ছবি দেখা যায়। এলসিডির সামনে কেউ না থাকলে আপনা আপনি ওগুলো অফ হয়ে যায়।
আশ্চর্য্য একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। শিল্পকলার সাইনবোর্ডে লেখা শিল্পকলা একাডেমি। ওকে বললাম, হ্যারে আমাদের সময়ের শিল্পকলা পরে শিল্পকলা হলো কীভাবে? ও বললো সে আরেক কাহিনী। এই গত বছর একজন মন্ত্রী শিল্পকলারই এক অনুষ্ঠানে শিল্পকলাকে শিল্পকমলা বলে ফেললেন। ওনাকে শুদ্ধ করে বলার জন্য চিরকুট দেয়া হলে উনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘বাংলার মধ্যেই আমার জন্ম, আমাকে বাংলা শেখাও। কলা আর কমলায় কী এমন পার্থক্য, দুটোই তো ফল।’ পরদিন ওনারই সম্মানে শিল্পকলা নামিয়ে শিল্পকমলা সাইনবোর্ড লাগানো হলো। আমি মনে মনে ভাললাম, বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হলেও অশিক্ষিত লোকদের ক্ষমতায় বসানোর কালচারটা তাহলে এখনও চালু আছে।
আমি মনে মনে ভাললাম, বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হলেও অশিক্ষিত লোকদের ক্ষমতায় বসানোর কালচারটা তাহলে এখনও চালু আছে।
কালো হোন; দুনিয়া জয় করুন।
শিল্পকমলা থেকে বেরিয়ে আমার নাতি বাসায় যাচ্ছে। হঠাৎ আলখাল্লা পড়া এক লোক ওর সামনে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে বললো ‘তোর ঘাড়েতো ভুত, তাড়াবি নাকি, মাত্র পাঁচশ টাকা।’ আমার নাতি বললো, ‘তাড়াতে হবে না ও ভালো ভুত, আমার দাদু’।
নাতিকে জিগ্যেস করলাম, এখন কী ফটোগ্রাফি শেখানোর প্রতিষ্ঠান নাই? আমাকে একটু দেখা না। ও আমাকে একটা ইন্সটিটিউটে নিয়ে এলো। একটা ছোট্ট অফিস, একজন মাত্র লোক। পাশের একটা রুমে একটা মাত্র কম্পিউটার। একটা শোকেসে গোটা বিশেক মাথার খুলি। আমাদের মুস্তাফা ভাইয়ের খুলিও সেখানে। আমি বললাম আমার খুলি কি এখানে নাই। ও বললো তোমার খুলি বছর পাঁচেক আগে চুরি হয়ে গেছে। তবে তোমার অভিজ্ঞতার স্মৃতি এই কম্পিউটারে আছে। বুঝলাম এখনও চোর আহে।

ফটোগ্রাফিতে ডিপ্লোমা করার জন্য একজন ছাত্র আসলো। সে নাকি ছয় ঘণ্টার মধ্যে ডিপ্লোমা করে পরের দিনই একটা বড় অ্যাসাইনমেন্টে চলে যাবে। আমার খুব কৌতুহল তৈরি হলো। দেখিনা কীভাবে কী হয়। পরিচালক ঐ ছেলের হাতে একটা মেনু ধরিয়ে দিলেন। সেখানে অতীতের বড় বড় ফটোগ্রাফারদের নাম লেখা। আমার পরিচিত অনেকের নাম দেখলাম। আমাদের গোলাম মুস্তাফা ভাইয়ের নামও ছিল। পাশে লেখা আছে, ”স্টিল ফটোগ্রাফি শিখলে ভিডিওগ্রাফি ফ্রি” ।
যথারীতি রেজিস্ট্রেশনের পর তাকে পাশের রুমে নেয়া হলো। কিছু ফিজিকাল টেস্ট করার পর তার কানের পাশে একটি ডাটা কেবল লাগানো হলো। এরপর কম্পিউটার থেকে একজন ফটোগ্রাকারের স্মৃতি ডাটা ক্যাবল দিয়ে তার মাথায় দেয়া হলো। ঐ সময় সে ভীষণ কাপছিল। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। মাত্র দশ মিনিটে কাজটি শেষ হলো। এরপর ওকে একটা বিছানায় শুইয়ে ঔষধ খাইয়ে ঘুমিয়ে দেয়া হলো। নাতিকে দিয়ে পরিচালককে জিগ্যেস করলাম ওকে ঘুমিয়ে দিলেন কেন? উনি বললেন, “ওকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমোতে হবে। এই পাঁচ ঘণ্টায় ওর পুরোনো স্মৃতিগুলোর সাথে নতুন স্মৃতিগুলোর ডিফ্রাগমেন্টেশন হবে।’
আমি জিগ্যেস করলাম মাথায় ডাটা ক্যাবল লাগানো কীভাবে সম্ভব হলো? আমার নাতি ওর নিজের কানের কাছের চুল সরিয়ে দেখালো, “কারো বয়স পাঁচ বছরের বেশি হলে এ রকম একটা অ্যাকসেসরি ছোট-খাটো অপারেশনের মাধ্যমে লাগিয়ে নেয়া যায়। এখন বেশীরভাগ মানুষের শরীরে এ রকম অ্যাক্সেসরিজ লাগানো আছে।
আমি ভেবে কুল পেলাম না কীভাবে অনেক বছর আগে মারা যাওয়া লোকগুলোর স্মৃতিকে মাথার খুলি থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হলো। আরো কত কিছুই না এখন সম্ভব হচ্ছে। দু’চারদিন পৃথিবীতে থাকতে পারলে অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই দেখা যেত।
রাস্তায় একটা বিশাল বিলবোর্ড চোখে পড়ল। একজন আফ্রিক্যান কালো সুন্দরীর ছবি, হাতে একটা কালো গোলাপ। লেখা আছে ‘কালো হোন, দুনিয়া জয় করুন। লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ।’ কী অবাক কাণ্ড। আমাদের সময়তো ফর্সা হওয়ার জন্য ক্রীম পাওয়া যেত। এখন কালো হওয়ার ক্রীম পাওয়া যায়। মানুষের রুচি পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে আন্তর্জাতিক মহাজনদের কী মজার ব্যবসা।
নাতি আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। ততক্ষণে ওর বৌ অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। বাংলাদেশী গঠনে নিগ্রোদের মতো কালো ত্বক। ও আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। আমার নাতি তরিঘড়ি করে ওর জন্য চা-নাস্তা বানালো ।
আমার নাতবৌ মাঝে মাঝে হাসছিল। মনে হলো কালো আঁধারের মধ্যে দাতগুলো তারার মতো জ্বলে উঠছে। আমার নাতি জানালো জন্মের পর সে কসাই ছিল, লিভার ব্রাদার্সের ক্রীম মেখে মেখে সে নিজেকে কালো বানিয়েছে। তাকে দেখে
মানুষ নাকি কালো পাথরের আমার বড় মায়া হলো। মনে হলো একটা কৃষ্ণ পাথরের মুর্তি আমার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

যৌবনের কথা আমার ভাসলো। স্মৃতিতে আমার ফর্সা স্ত্রীকে এত মায়াবী মনে হতো না। পৃথিবীতে থেকে যেতে ইচ্ছে করলো। সাথে সাথে একটা শব্দ ভেসে আসলো যেটা শুধু আমিই শুনলাম, তোমার মাত্র এক মিনিট বাকি আছে।
বিদায় পৃথিবী।
ইলাস্ট্রেশন: লেখক।